১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভারতীয় সেনা প্রেরণ করেছিলেন। এই হস্তক্ষেপটি নয়টি সংক্ষিপ্ত দিনে যুদ্ধের উপসংহার এনেছিল এবং গণহত্যার ও জাতিগত নির্মূলকরণের নয় মাসের অভিযানের অবসান ঘটিয়েছিল। যাতে অগণিত লোক মারা গিয়েছিল এবং হাজার হাজার হয়েছিল গৃহহারা। সুতরাং, স্বাধীনতার প্রাক্কালে, মনে হয়েছিল যে এর ফলে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে একটি দুর্দান্ত প্রেম-সম্পর্কের অবস্থা তৈরি হয়ে গেল। এই রোম্যান্সটি আমাদের ভূগউলিক বিন্যাস দ্বারা আরও প্রভাবিত হয়ে উঠেছিল: ভারত বাংলাদেশকে তিনদিকে ঘিরে রেখেছে, একটি সীমান্তের দুর্দান্ত নেকড়ের মত। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দশকগুলিতে এই বিষয়টি বাংলাদেশের জনগনের কাছে দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে উঠেছ। বাংলাদেশের জনগন বুঝতে পেরেছে যে ইন্দিরা গান্ধী বগলের নিচে সাপ লুকিয়ে শেখ মুজিবের সাথে পিরীত করেছিল।
ঝামেলা শুরু থেকেই প্রায় শুরু হয়েছিল। যুদ্ধে হস্তক্ষেপের পরে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যে সকল কর্মকাণ্ড করেছিল তা ছিল আপত্তিকর। বন্ধুর বেশে এসে তারা মনিব হবার প্রয়াস পেয়েছিল। তারা বিজয়ী সৈন্যদের মতো আচরণ করেছিল। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি – একাত্তরের ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি ছিল একজন ভারতীয় জেনারেল এবং একজন পাকিস্তানি জেনারেলের মধ্যে। হঠাৎ যে মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাতে তাদের কৃতিত্ব ও সফলতাকে ম্লান করে দিয়ে সকল সফলতা ও বিজয়ের কৃতিত্বের দাবীদার হয়ে বসল ভারতীয় সেনারা। যে মুক্তিসেনারা সীমিত অস্ত্র শস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম দিয়ে অনেক অমানশিক কষ্টের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছিল সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে না দিয়ে ভারতীয় সেনাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ ছাড়াও ভারতীয় বাহিনীরা সদ্যমুক্ত বাংলাদেশ ছেরে যাবার পূর্বে অস্ত্র শস্ত্র ও বিভিন্ন মুল্যবান জিনিষপত্র এমনকি হাসপাতালের ম্যাটরেসও তুলে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা উত্তর নব্য বাংলাদেশের প্রধান হয়ে শেখ মুজিব ভারতের সাথে বিভিন্ন গোপন চুক্তির মাধ্যমে তাদের গোলামির জিঞ্জিরে বন্দী হয়ে যায়।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক শীঘ্রই আরও প্রসার লাভ করেছিল। ১৯৭৫ সালে, ভারত সরকার বাংলাদেশের সীমানা থেকে ১০ মাইল দূরে ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি করেছিল; এটি গঙ্গার জল হুগলি নদীর অববাহিকায় সরিয়ে নিয়েছে, এতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে , মৎস্যখামারগুলিকে দূষিত করেছে , নৌ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বাংলাদেশী এলাকা এতে দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক গ্রাম খরাতে আক্রান্ত হয়ে গেছে, যে কারণে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবলতর হতে শুরু করেছিল যা তখন থেকেই বাংলাদেশের কাছে ভারতের জনপ্রিয়তায় ঘুন ধরেছে। আবার দেশের কিছু লোক ভারত প্রেমে গদ্গদ হয়ে তাদের সংস্কৃতি ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার ও আমদানি করাতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের দ্রব্যসামগ্রী চুক্তি মোতাবেক ভারতে প্রবেশ করতে দেয় না, অথচ ভারতের সকল প্রকার দ্রব্যসামগ্রী বাংলাদেশে অনায়াসে চলে আসে। চিকিতসা, শিক্ষা ও ব্যবসা বানিজ্যের জন্য বাংলাদেশ ভারতের একটি লাভজনক ময়দান। ভারতিয় অনেক প্রবাসীদের মাধ্যমে তারা সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
গড় নাগরিকের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতিবছর ভারতকে $ ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য করে। তবুও ভারত তার অর্থনৈতিক সীমানা বাংলাদেশে খুলতে রাজি নয়। এখনও একটি বাস্তবায়িত অর্থনৈতিক চুক্তি হতে পারে যা আমাদের পণ্যগুলি ভারী শুল্ক ছাড়াই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারে। এই বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা কেবলমাত্র সেই অনুভূতিটিকেই শক্তিশালী করে তোলে যে আমরা তাদের করুনার ছায়ায় বাস করি। ভারত বাংলাদেশকেও মুসলিম দেশ হিসাবে বিশ্বের কাছে মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। ভারতিয়দের আমি বিদেশের মাটিতে বসেও দেখেছি তারা সর্বক্ষেত্রে বাঙ্গালীদের হিংসা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। কোন স্বার্থ আদায়ের সময় বন্ধুর অভিনয় করে কিন্তু সময়মত পিছন হতে ছুরি মারে। সম্ভবত একাত্তরের শরণার্থী সঙ্কটের অনুরূপ একটি সমস্যা তারা সৃষ্টি করতে চায় যাতে বাংলাদেশ আবার পিছিয়ে পরে। ভারত সবসময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ধর্মীয় ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করার জন্য প্রস্তুত ও নানা ফন্দি আটতে ব্যস্ত। অনেকে বাংলাদেশের পাট শিল্প ধংস, গার্মেন্টস শিল্পের মন্দাবাজার,রাজনিতির অস্তিরতা ইত্যাদির জন্য ভারতকে দোষারোপ করে।
আমরা ভারতকে ভালোবাসতে পারি না। রোম্যান্সের জন্য সম্পর্কটি খুব অসম এবং সে আমাদের প্রতিবেশী উদার অভিভাবক হিসাবে আত্মনিয়োগ করতে খুব আগ্রাসীভাবে স্ব-আগ্রহী। আমাদের হয় আমাদের যা আছে তা নিয়ে বাঁচতে হবে, বা উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, উপমহাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের দুটি পারমাণবিক শক্তির মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভৌগলিক সুবিধাকে সমর্থন করতে পারি। আমাদের নিজস্ব রোম্যান্স না থাকলে কমপক্ষে আমরা ম্যাচমেকার হয়ে উঠতে পারি। এবং ভারত যেভাবে তার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে আচরণ করে তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে আমরা নিজেই বহুবচনবাদী সমাজের উদাহরণ হতে পারি। তবে অস্বস্তিকর সত্যটি হ’ল আমাদের উদ্বেগগুলি ধর্মীয় কুসংস্কারের লেন্সের মাধ্যমে প্রদর্শিত এবং স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। আশ্চর্যের বিষয় এমনকি ১৯৭১ সাল থেকে, বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী ঘরে বসে অনুভব করতে পারেনি, তারা এখানে বাংলাদেশে অর্থোপার্জন শুরু করে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতে তহবিল স্থানান্তর করে সেখানে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে চলেছে। অন্য ধর্মের গোষ্ঠীর লোকেরা দেশে সর্বদা সুখী এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাস করছে, তবে কেবল হিন্দুরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের জাল বিস্তারের অভিনয় করছে।
পরিশেষে, আমাদের ভাগ্যকে দোষ দেওয়ার পরিবর্তে আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারি, দুর্নীতির রাজনৈতিক আড়ম্বর থেকে মুক্তি দিতে পারি এবং আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে পুঁজি করতে পারি – যা প্রাকৃতিক ও স্ব-ক্ষতিগ্রস্থ উভয় দুর্যোগ সত্ত্বেও একটি স্বাস্থ্যকর অবস্থানে দাড় করাতে পারি। খেলার মাঠ সমতল করার একটি আরও ভাল কাজ করে, আমরা এখনও ভারতের সাথে রোমান্সের সুযোগ নাও পেতে পারি, তবে আমরা অন্তত পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কের দিকে কাজ করতে পারি।