একনায়কত্বের অবসান: অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত সামরিক কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন এবং পদায়নের পরিকল্পনা 

পটভূমি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন সহ্য করেছে, যা রাজনৈতিক অপব্যবহার এবং প্রতিষ্ঠানিক অখণ্ডতার ক্ষতিসাধনের এক কালো অধ্যায়। হাসিনার সরকার, বিশেষ করে ভারতের মতো বিদেশি শক্তির সহায়তায়, দেশের প্রতিটি খাত, এমনকি একসময় পেশাদার ও নিরপেক্ষ সশস্ত্র বাহিনীকেও রাজনীতির শিকলে বন্দী করেছিল। তার শাসনামলে ৫০০ জনেরও বেশি সামরিক কর্মকর্তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, অকালেই অবসরে পাঠানো হয়েছে, বরখাস্ত করা হয়েছে বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এই কর্মকর্তারা, যারা প্রত্যেকেই উচ্চ প্রশিক্ষিত, শিক্ষিত, এবং অভিজ্ঞ পেশাজীবী, তাদের জীবনে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিক বিশৃঙ্খলায় পড়তে হয়েছে। রাতারাতি তারা জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে, যা একজন সেবারত কর্মকর্তার জীবনে এক বড় ধাক্কা ছিল। তাদের বেশিরভাগই সামরিক বাহিনীর মধ্য ও সিনিয়র স্তরের কর্মকর্তা ছিলেন, যা তাদের জীবনের এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যেখানে পুনঃনিয়োগের সুযোগ সীমিত ছিল এবং বেকারত্বের প্রভাব সর্বাধিক তীব্র ছিল।

কর্মকর্তাদের উপর অন্যায় ও অমানবিক আচরণের ফলে এই কর্মকর্তারা  যে অবিচারের শিকার হয়েছেন, তা কয়েকটি দিক থেকে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে:

অর্থনৈতিক বিপর্যয়:

অনেক কর্মকর্তা পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের পদ হারানোর ফলে তারা ন্যূনতম আর্থিক দায়বদ্ধতা পূরণ করতে লড়াই করতে হয়েছে, তাদের সামরিক ক্যারিয়ারের মান অনুযায়ী জীবনযাপন তো দূরের কথা।

সামাজিক কলঙ্ক বিচ্ছিন্নতা:

সমাজের সম্মানিত সদস্য হিসেবে, তারা তাদের কষ্ট প্রকাশ করতে পারেনি। তারা যে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তা প্রকাশ করলে সরকারী প্রতিশোধ বা তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব:

তাদের বরখাস্তের আকস্মিকতা এবং অন্যায় প্রকৃতি গভীর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত তৈরি করেছে। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে সম্মান ধরে রাখার পর তারা হঠাৎ এমন একটি শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে পড়েছিলেন, যা তারা নীরবেই মোকাবিলা করতে হয়েছে।

এই কর্মকর্তারা পেশাগত ত্রুটির জন্য নয় বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। তারা একটি শাসনব্যবস্থার শিকার, যা ভিন্নমতকে শাস্তি দিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার দিকে ঝুঁকেছিল।

পুনর্বাসনের পথ

হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিকদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন দেশের পুনর্গঠনের পথ সুগম করেছে, যা ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। এখন দেশের উচিত অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করা, শুরু করতে হবে সেই কর্মকর্তাদের থেকে যারা পূর্ববর্তী শাসনামলে ভুক্তভোগী হয়েছিলেন।

তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে এবং তাদেরকে পুনরায় জনসেবায় ফিরিয়ে আনার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া উচিত:

পুনর্বাসন কমিশন গঠন:

 নতুন সরকারের অধীনে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করা উচিত, যাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য, সামরিক নেতৃত্ব, আইনি বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই কমিশন জোরপূর্বক অবসর, বরখাস্ত এবং অযোগ্যতার কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাগুলি তদন্ত করবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করবে।

কমিশনের পদক্ষেপ:

প্রতিটি মামলার তদন্ত: কমিশন প্রতিটি কর্মকর্তার অবস্থা গভীরভাবে পর্যালোচনা করবে, প্রাসঙ্গিক নথি ও রেকর্ড সংগ্রহ করবে এবং তাদের বঞ্চনার পটভূমি ও কারণগুলি বুঝতে চেষ্টা করবে।

ন্যায্যতা মূল্যায়ন: কমিশন প্রতিটি মামলার গুণগত মূল্যায়ন করবে এবং সেই প্রেক্ষাপটে কর্মকর্তার পদ, পদমর্যাদা বা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ বিচার করবে।

পদে পুনঃস্থাপনের সুপারিশ: যেখানে সম্ভব, কমিশন কর্মকর্তাদের পূর্বের পদ বা পদমর্যাদায় পুনর্বহালের সুপারিশ করবে, যদি তারা অন্যায়ভাবে বরখাস্ত বা অবনমিত হয়ে থাকেন।

পদোন্নতি সুবিধা: প্রয়োজনে, কমিশন মূল্যায়ন করবে যে কর্মকর্তারা পূর্বে মঞ্জুরিপ্রাপ্ত পদোন্নতি বা অন্য কোনো সুবিধার জন্য যোগ্য ছিলেন কিনা এবং প্রাসঙ্গিক সুপারিশ করবে।

নাগরিক প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তি: যারা সক্রিয় দায়িত্বে পুনর্বহাল হতে পারবেন না, তাদের নাগরিক প্রশাসন বা অন্যান্য সরকারি কাজে অন্তর্ভুক্তির সুযোগের সুপারিশ করা উচিত, যাতে তাদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দেশের পুনর্গঠনে কাজে লাগানো যায়।

পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা: কমিশন একটি সময়সীমা নির্ধারণ করবে, যাতে তাদের সুপারিশগুলো কার্যকর হচ্ছে কিনা তা পর্যায়ক্রমে পর্যালোচনা করা যায় এবং প্রয়োজনে সমস্যার সমাধান করা যায়।

পুনর্বহাল এবং পুনঃএকীভূতকরণ:

যেখানে সম্ভব, কমিশন কর্মকর্তাদের তাদের সংশ্লিষ্ট সামরিক শাখায় পুনর্বহালের সুপারিশ করবে। তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ ও পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যদি সশস্ত্র বাহিনীতে পুনর্বহাল সম্ভব না হয়, তবে তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বেসামরিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যেখানে তাদের নেতৃত্ব এবং কার্যনির্বাহী অভিজ্ঞতা দেশ গঠনে অপরিহার্য হবে।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ:

 কিছু কর্মকর্তা হয়তো ঐতিহ্যবাহী অবসর বয়সের কাছাকাছি পৌঁছেছেন বা বিকল্প কর্মসংস্থানের রাস্তা খুঁজতে আগ্রহী হতে পারেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে, সরকার তাদের সরকারি প্রশাসন, বৈদেশিক সেবা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব দিতে পারে। এটি তাদের দক্ষতা ব্যবহার নিশ্চিত করবে এবং একইসঙ্গে তাদের একটি স্থিতিশীল জীবিকা সরবরাহ করবে।

পরামর্শ এবং সহায়তা কর্মসূচি:

এই কর্মকর্তাদের ওপর যে মানসিক ও মানসিক চাপ পড়েছে তা উপেক্ষা করা যাবে না। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাদের এবং তাদের পরিবারের জন্য মানসিক পরামর্শ এবং সহায়তা কর্মসূচি রয়েছে, যা তাদের এই অন্যায় আচরণ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন প্রদান করবে।

অন্যায়ের প্রকাশ্য স্বীকৃতি:

 নতুন সরকারের উচিত জনসমক্ষে এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের স্বীকৃতি দেওয়া। রাষ্ট্র কর্তৃক একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে। এটি একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠাবে যে নতুন নেতৃত্ব ন্যায়বিচার এবং দায়বদ্ধতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের সহযোগিতা:

সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান  বাহিনীর প্রধানদের উচিত কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মকর্তাদের পুনঃএকীভূত করার উপায় খুঁজে বের করা। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া যাতে উভয় পক্ষের জন্য ন্যায্য এবং উপকারী হয়, তা নিশ্চিত করতে তাদের দক্ষতা এবং দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

উপসংহার

 হাসিনা সরকারের পতন বাংলাদেশের জন্য অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করার এবং ন্যায়বিচার, পেশাদারিত্ব এবং জাতীয় গৌরবের ভিত্তিতে তার প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের জন্য একটি অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। বহিষ্কৃত কর্মকর্তারা দেশের সবচেয়ে মেধাবী এবং সক্ষম ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাদের পুনর্বাসন একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তাদের ক্যারিয়ার এবং জীবিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে, নতুন সরকার ন্যায়বিচারের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করতে পারে এবং বাংলাদেশের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ তৈরি করতে পারে।


Leave a comment