অভ্যন্তরীণ সংঘাত নাকি বহিরাগত খেলা? নুরুল হক নুর ঘটনার প্রেক্ষাপট

ব্রিঃ জেঃ(অব) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন  

সাম্প্রতিক সময়ে গনঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরের ওপর হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে আবারও নাড়া দিয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং একে অবশ্যই নিন্দা করতে হবে। তবে একইসাথে ঘটনাটির পেছনে যে জটিল প্রেক্ষাপট রয়েছে, তা বোঝা জরুরি। বিজয়নগরে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের কর্মীরা মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, শ্লোগান থেকে শুরু করে হাতাহাতি এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নেয় পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে যখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং নিজেরাই আক্রমণের শিকার হয়, তখন সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়। এসময় ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে বলপ্রয়োগ করা হয় এবং উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন, যাদের মধ্যে নুরও ছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলো হামলাটির নিন্দা জানালেও এটাও সত্য যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নুর একাধিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাকে নিয়ে অভিযোগ ওঠে—তিনি মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন, কিছদিন পূর্বে তার উপর কর্নেল মসিউজ্জামান কর্তৃক হামলার মিথ্যা গল্প প্রচার করেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে (যেমন মোসাদ) প্রকারন্তরে র’ এর সাথে  সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে জানা যায়।২০১৮ সালের কোঠা আন্দোলন ও  ২০২৪  সালের জুলাই বিপ্লবে তার সক্রিয়তা থাকলেও অনেকের মতে তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক নন, বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী সুযোগ নিতে অভ্যস্ত একজন  ভন্ড রাজনীতিক।

এখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে, এটি কি কেবল একটি আকস্মিক রাজনৈতিক সংঘর্ষ, নাকি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার কোনো বৃহত্তর খেলার অংশ? ক্রমশই ধারণা শক্তিশালী হচ্ছে যে এ ধরনের ঘটনাকে ইন্ধন যোগানো হচ্ছে—যাতে দেশে বিশৃঙ্খলা বাড়ে, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয় এবং আসন্ন নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ১৯৭১ সাল থেকে ভারত শুধু বাংলাদেশের মুক্তির সহযাত্রী হিসেবেই নয়, বরং অভিভাবক ও প্রভু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। কূটনীতি বা অর্থনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট না হলে, ভারত বেছে নেয় বয়ান ও বিভ্রান্তির কৌশল—যা বাংলাদেশকে দুর্বল করার জন্য এক ধরনের ন্যারেটিভ ওয়ারফেয়ার।

ভারতের কৌশল বরাবরই দ্বিমুখী—একদিকে প্রকাশ্য কূটনীতি ও বন্ধুত্বের বয়ান, অন্যদিকে অন্তরালে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও বিভাজনের খেলা। বাংলাদেশের ভেতরে তারা দীর্ঘদিন ধরে এমন এক পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছে যেখানে জনগণ সবসময়ই সন্দেহ ও অবিশ্বাসে বিভক্ত থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত বলে আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে একদিকে তাদের জনসমর্থনকে দুর্বল করা হয়, অন্যদিকে বিরোধী শিবিরে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম দেওয়া হয়। এতে রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে যায় এবং প্রতিটি শিবির অন্য শিবিরকে শুধু শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করে।

এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়াই ভারতের আরেকটি বড় কৌশল। একেকটি ঘটনায় তারা কখনো এক পক্ষকে, কখনো অন্য পক্ষকে পরোক্ষভাবে উৎসাহ দেয়—ফলে সংঘাত অব্যাহত থাকে। যখন এসব সংঘাত সহিংস রূপ নেয়, তখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরে যায় আসল সমস্যার দিক থেকে—যেমন ভারতের অনুপ্রবেশ, কূটনৈতিক চাপ বা অর্থনৈতিক আধিপত্য—এবং পুরো আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ। এভাবে ভারত আসল ইস্যুগুলোকে আড়াল করে নিজের প্রভাব বিস্তার ধরে রাখে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ নিজেই নিজের সমস্যায় জর্জরিত, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় অনেক সময় সেই সমস্যাগুলোকে তৈরি ও বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা থাকে। এর মাধ্যমে ভারত কেবল কূটনৈতিক চাপই তৈরি করে না, বরং জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেও দুর্বল করে রাখে। একটি বিভক্ত ও অস্থির বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনেক বেশি সুবিধাজনক, কারণ তখন ঢাকা কোনো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বা স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি চালাতে পারে না।

নুরুল হক নুরের মতো নেতাদের ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক ভূমিকা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার জন্য একটি সহজ বাহন হয়ে ওঠে। তাদের বিতর্কিত অতীত ও রাজনৈতিক জীবনের অসঙ্গতিপূর্ণ কার্যকলাপ তাদের জনসমর্থনকে সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ রাখে। একজন রাজনৈতিক নেতা যদি ধারাবাহিক নীতির বদলে হঠাৎ হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন করেন, একদিন এক বক্তব্য দেন, আরেকদিন সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নেন, তবে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। একইসাথে উগ্র বা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য এবং সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ড রাজনীতিকে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করার বদলে রাস্তায় সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। এ ধরনের আচরণ বহিরাগত শক্তির জন্য আদর্শ সুযোগ তৈরি করে। ভারত বহুদিন ধরে বাংলাদেশে বিভাজন ও অস্থিতিশীলতার কৌশল ব্যবহার করছে। নুরের মতো নেতাদের অস্থির, অনিশ্চিত ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ভারতের পক্ষে সহজেই প্রচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তারা দেখাতে পারে—বাংলাদেশের রাজনীতি অপরিণত, নেতারা দায়িত্বশীল নন, এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার ব্যাহত হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দুর্বল হয় এবং ভারতের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আরও দৃঢ় হয়।

নুরুল হক নুরের মতো নেতাদের কর্মকাণ্ড সচেতনভাবে ভারতের স্বার্থে না হলেও বাস্তবে তা ভারতের কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়। কারণ যত বেশি বিশৃঙ্খলা, যত বেশি অনাস্থা, তত বেশি ভারত তার আধিপত্য বজায় রাখার সুযোগ পায়। ভারতের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে এমন অবস্থায় রাখা যেখানে ঢাকা সবসময় অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত থাকবে এবং বড় কোনো জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে স্বাধীন অবস্থান নিতে পারবে না। ফলে ভারতের প্রভাব শুধু রাজনীতির ভেতরে নয়, কূটনীতি ও অর্থনীতিতেও শক্তিশালী থেকে যায়।

এই প্রেক্ষাপটে সরকারের দায়িত্ব দ্বিমুখী। প্রথমত, সহিংসতার ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা নীতি কার্যকর করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হোক বা ছাত্র সংগঠনের সমর্থক—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ, জনসাধারণের সম্পদ ধ্বংস এবং সহিংসতা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারের প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রে যেসব ব্যক্তি এখনও অতীতের ফ্যাসিবাদী শাসনের সহযোগী এবং ভারতীয় প্রভাবের অংশ হয়ে আছেন, তাদের চিহ্নিত করে পরিষ্কার করতে হবে। এই ক্লিনসিং প্রক্রিয়া ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের সমতল মাঠ তৈরি হবে না এবং ভারত গোপন নেটওয়ার্ক ও অনুগত সহযোগীদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে।

সুতরাং নুরুল হক নুরের ওপর হামলাটি কেবল রাজনৈতিক সহিংসতার একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়; এটি আমাদের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন। মানুষ এখন প্রশ্ন করছে, এটি কি কেবল একটি দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিতভাবে দেশের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা? অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার সক্ষমতাকে দুর্বল দেখাতে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নষ্ট করতে এবং বাংলাদেশকে আবারও ভারতীয় প্রভাবের ছায়ায় নিয়ে যেতে সাজানো হচ্ছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্য প্রকাশ পাবে, তবে ইতিমধ্যেই একটি শিক্ষা স্পষ্ট: বাংলাদেশকে বিভক্ত বা বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। দেশের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র রক্ষায় সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যন্ত্র থেকে বিদেশি প্রভাবের সহযোগীদের সরাতে হবে। ভারত সবসময়ই বিভক্তি ও বিভ্রান্তির মাধ্যমে আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করবে, কিন্তু বাংলাদেশের দায়িত্ব হলো ঐক্যবদ্ধ থেকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি হতে হবে—বন্ধু চাই, প্রভু নয়; অগ্রগতি চাই, বিশৃঙ্খলা নয়। কেবল দেশপ্রেম, সততা ও দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে আমরা নিজের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে তুলতে পারব।


Leave a comment